Sunday, April 22, 2018

মানবসত্তার অভিপ্রায়ঃ দ্বন্দ্বের নানা মুখ

মানবসত্তার অভিপ্রায়ঃ দ্বন্দ্বের নানা মুখ




আবীর চট্টোপাধ্যায়

১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অব্যবহিত সময়ে যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউরোপের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ যখন তাদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে পুনর্গঠনের নামে আসলে গঠনগত আপোষে ব্যস্ত তখন মার্কিনী তাত্ত্বিক হ্যারল্ড লাসওয়েল যখন জ্ঞাপন বলতে মুখ্যত মৌখিক জ্ঞাপনকে মাথায় রেখে মুখ্যত অ্যারিস্টটলীয় ঢঙে একটা সরলরৈখিক বাচিক আলংকারিক কাঠামো রচনা করলেন কাঠামোটি অনেকটা এইরকমঃ 'কে বলল, কি বলল, কাকে বলল এবং কী তার ফল হলো'। ভাবটি ছিল এমন, যে এই কাঠামো মানুষের জ্ঞাপন প্রক্রিয়াকে একটা সাধারণ সর্বজনগ্রাহ্য মাত্রা দিল। জ্ঞাপন পঠনজগতে এমন কথা মেনেও নেওয়া হলো। কিন্তু মানবসভ্যতার আধুনিকতার প্রায় শেষ পর্বে এসে যুদ্ধবিদ্ধস্ত, সর্বঅভিজ্ঞতাপুষ্ট এবং ছেঁড়াখোঁড়া খোবলানো পৃথিবীটাতে হঠাৎ এমন অতিসরলীকৃত কাঠামোর অন্দরের কারণটি যাই হোক না কেন তাকে মেনে নিতে গেলে যতটা ইতিহাস বিচ্ছিন্নতার দরকার হয়, তার জন্য দারিদ্র্য, অনাহারক্লিষ্ট, জখম, আহত মানুষের জ্ঞাপনের সর্বজনীন কোনো তত্ত্ব এত সরলীকৃত এবং প্রাগৈতিহাসিক মানের হতে পারে না। তাহলে একদিকে এই কাঠামো জ্ঞাপনকারী মানুষকে একটা প্রজন্মের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে অর্থাৎ যা হয়েছে তা বিগত, এখন সামনের দিকে অথবা আমার দিকে তাকাও, আর অন্যদিকে জ্ঞাপনকারী সংস্থা বা মানুষের 'কে' 'কি' ‘কেন’ ইত্যাদি যত বৃত্তান্ত সব সমান করে অথবা অসাম্যগুলোকে উপেক্ষা করেই তবে জ্ঞাপন বিচার করা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, যেমনটি লাসওয়েল বলছেন, জ্ঞাপন হওয়ার সময় কি আদৌ জ্ঞাপনকারী বা 'আমি' 'কে' তা নিশ্চিত হয়ে যায়? কোনো বিশেষ সময়-পরিসরে জ্ঞাপন থেকে 'আমি' 'কে' তা নিশ্চিত করে চিহ্নিত করা যায়? ফরাসী তাত্ত্বিক মিশেল ফুকো বলেছিলেন 'আমি'র খোঁজ পেতে হলে জ্ঞাপনের সময় নয়, তার ইতিহাসে সেই 'আমি'র খোঁজ করা প্রয়োজন আর যদি কোনোভাবে তা জানাও যায়, তাহলে কার কাছে তা প্রতিষ্ঠিত হয়? যার উদ্দেশে জ্ঞাপন করা হয়েছে তার কাছে? তাহলে হ্যারল্ড লাসওয়েল নিজে কি জ্ঞাপনক্ষেত্রে সেই তৃতীয় ব্যক্তি যাঁকে সমাজবিজ্ঞানে সুপার-অবজার্ভার বলা হয়েছে যিনি জ্ঞাপনে অংশগ্রহণ না করেও বাইরে থেকে জ্ঞাপন প্রক্রিয়াকে সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারেন? এ ক্ষেত্রে তিনি যেন সেই ব্যক্তি যিনি কন্টেন্ট অ্যানালিসিস'এর নামে আসলে 'জ্ঞাপনকালীন' পরিচয়, বার্তা, বিষয়, এবং তার প্রভাব সবই বুঝে যাচ্ছেনতাই যদি হয়, তাহলে লাসওয়েল নিশ্চয় বিশেষ অথবা অদৃশ্য কোনো কারণে 'আমি' 'কে' বিষয়টিকে সবার সাথে এক করে প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর এইভাবে যাঁর উদ্দেশে জ্ঞাপন করা হলো সেই মানুষটি বা গ্রহীতাকেও একদরে বিচার করেছেন কারণ অন্তিমে গ্রহীতার উপর জ্ঞাপনবার্তার কী প্রভাব হলো তাকেও তো একটা কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছেন। আর পঠনজগত এ বিষয়ে এতটাই আচ্ছন্ন যে গ্রহীতার প্রতিক্রিয়ার আশাও করে ফেলেছে লাসওয়েল'এর কাছেকিন্তু জ্ঞাপনে গ্রহীতার উপর কী প্রভাব পড়ল তা তো এই সময়-পরিসরের কাঠামোয় বন্দী বা সীমাবদ্ধ থাকার কথা নয়। কারণ গ্রহীতার মনে বার্তা কী প্রভাব ফেলবে আর কতক্ষণ সেই মনে অনুরণিত হবে আর তিনি কখন তার প্রতিক্রিয়া দেবেন অথবা তিনি প্রতিবার্তায় কিছু নতুন বলবেন কিনা তা তো এই কাঠামোর বাইরে অন্য কোনো সময়-পরিসরে ঘটবে, এমনকি তাও নিশ্চিত হয়ে নিরূপণ করা যাবে না। ফলে এই জ্ঞাপনকালীন পরিসরে কেমন করে গ্রহীতার প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করা যাবে? এইভাবে বিচার করতে থাকলে দেখা যাবে একসময় আসল কাঠামোটাই ভেঙ্গে পড়ছে
কিন্তু জ্ঞাপনক্রিয়ায় কোনো উপায়ে যদি জ্ঞাপনকারী এবং গ্রহীতার ভূমিকা নিশ্চিত করা যায় কেবলমাত্র তাহলেই তারা 'কে' 'কি' সবই তখন এক পংক্তিতে স্থির করা যাবে এমনকি নিয়ন্ত্রণ করাও যাবেকিন্তু কীভাবে এদের ভূমিকা নিশ্চিত করা যায়? বিশেষ কোনো সময়-পরিসরে অর্থাৎ বিশেষ কোনো স্থান, কাল, পাত্রে অথবা বিশেষ কোনো 'কন্ডিশন' বা অবস্থার সৃষ্টি ক'রেআসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একদিকে যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউরোপ অন্যদিকে উপনিবেশক্লিষ্ট তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি আপ্রাণ লড়ে যাচ্ছিল তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ সুদৃঢ় করার লক্ষে। এই উন্নয়নযজ্ঞে একদিকে যেমন তাদের বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন ছিল অন্যদিকে তেমন প্রধান সাহায্যকারী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রদেয় উন্নয়ন পরিকল্পনার নেপথ্যে মূল লক্ষই ছিল এই দেশগুলির নাগরিকতা তথা সামাজিকতা এবং সার্বিক স্বকীয়তাকে পূর্ণমাত্রায় প্রভাবিত করা। এ কাজে জনবৈচিত্র্যকে একমাত্রায় আনতে গেলে প্রথমেই সম্ভাব্য সামাজিক ক্ষেত্রগুলিতে জ্ঞাপনক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী মানুষের বিষয়গত, মতাদর্শগত, নীতিগত এবং আপন পরিসরগত স্বাভাবিক বৈচিত্র্য ও বহুত্বকে নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার ছিল। তাই প্রথম থেকেই জ্ঞাপনভাবনার যাবতীয় বৈচিত্র্যকে একছাতার বিশ্লেষণের আওতায় আনার লক্ষ্যে শুধু লাসওয়েল কেন, শ্যানোন-উয়েভার'এর কাঠামো তথা সমস্ত সরলরৈখিক মডেলগুলিই এই একইভাবে জ্ঞাপনকারী-গ্রহীতার ভূমিকা নিশ্চিত করেছিল।কীভাবে তা করা হয়েছিল? একদিকে জ্ঞাপনপ্রযুক্তির ব্যাপক কেন্দ্রীভবন ও প্রসার এবং অন্যদিকে গণমাধ্যমের সম্প্রচারিত তথ্যবার্তার কেন্দ্রীভবন  প্রসার ঘটিয়ে জ্ঞাপনে অংশগ্রহণকারীর ভূমিকা অনেকাংশে নিশ্চিত করা হয়েছিল। কেন্দ্রীভবনের পাশাপাশি একদিকে প্রযুক্তি তথা বার্তার পরিমাণগত বিস্তার ঘটল যথেষ্ট অন্যদিকে বার্তাশূণ্য পরিসরের বৃদ্ধিও ঘটল পাশাপাশি। কিন্তু এই বিস্তার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে এমন কেন্দ্রীভবন সৃষ্টি করল যেখানে মানুষের সামাজিক সক্রিয়তার প্রসারই গেল থমকে।

ফলে এইভাবে মানুষের জ্ঞাপন ভূমিকা নিশ্চিতভাবে বিশ্লেষণ করতে এবং বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিনির্ভর বার্তার সম্প্রচার করতে গিয়ে যে কান্ডটি ঘটল তা হলো বার্তা এবং বার্তার ভাষার প্রাচুর্যসত্ত্বেও এক সামগ্রিক অর্থশূণ্যতা বা অর্থের অপ্রয়োজনীতার প্রতিষ্ঠা এমন অর্থশূণ্যতার প্রতিষ্ঠা আজও সমাজপটের সামগ্রিকতা বা সামগ্রিক চৈতন্যে ও সক্রিয়তার আড়ালে এক সার্বিক অচেতনে ঘটে চলেছে। অর্থাৎ বার্তা গৃহীত হচ্ছে নির্দিষ্টভঙ্গীতে কিন্তু তার অর্থপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজন বা সামাজিকভাবে তার প্রভাব অতি সীমাবদ্ধ। কাজেই এই পরিস্থিতিতে যাই জ্ঞাপন করা হোক গ্রহীতা তা বুঝবেই, অন্তত বিনা বাক্যব্যয়ে, বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ তো করবেই - এমনই এক অসাম্যের ধারণা বা নীতি পাঠক চৈতন্যে এবং পঠনসংস্কৃতির তথাকথিত সচেতনতার আড়ালে বা নেপথ্যেই বৈধতা পেয়েছে আর ঠিক এরই বিপরীতে গড়ে উঠেছে আর একটি ধারণা অর্থাৎ গণমাধ্যম যা কিছু সম্প্রচার করবে তা তো নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ অথবা সমাজের পক্ষে নিশ্চয়ই কল্যাণকরস্বভাবতই সামাজিক ক্ষেত্রে নানা প্রয়োজনে জ্ঞাপন আর সেই জ্ঞাপনের বৈচিত্র্যকে প্রভাবিত করতে গণমাধ্যমের প্রভাবশালী জ্ঞাপনের ফলে সামগ্রিকভাবে জনক্ষেত্রে জ্ঞাপনের যে স্বাভাবিক বৈচিত্র্য সেখানেই জনবার্তার উদ্দেশ্য এবং গঠনেই অনিশ্চিতি সৃষ্টি হয়েছেবিষয়টা তাই এমন দাঁড়িয়েছে, যেমন তেমন একটা বার্তা প্রভাবশালী জ্ঞাপনকারী থেকে গণমাধ্যম যেই জ্ঞাপন করুক না কেন, তা তো গৃহীত হবেই। এইভাবে সামাজিক পটে সামগ্রিকভাবে মানুষের ভাবনার বা অভিপ্রায়ের এক সার্বিক দ্বন্দ্বহীনতার মত প্রতিষ্ঠিত হয়ে চলেছে কীরকম দ্বন্দ্বহীনতা? দৈনন্দিন জ্ঞাপনসক্রিয়তা এবং সম্প্রচারিত জ্ঞাপনবার্তার মধ্যেকার দ্বন্দ্বহীনতা। এ এক এমনমাত্রার দ্বন্দ্বহীনতা যেখানে যে কোনো পর্যায়ে গণমাধ্যমের সম্প্রচারিত বার্তা মুখ্যত মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অর্থাৎ জ্ঞাপনসক্রিয়তার উপর প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়তবে একথাও মনে রাখতে হবে এই দ্বন্দ্বহীনতা খুব স্বাভাবিক পরিণতি নয়, কারণ এর নেপথ্যেও এক অতি শক্তিশালী সিগনিফায়েড বা ধারণা প্রতিষ্ঠিতযেমন সাম্প্রতিক সময়ে যে কোনো ধরণের প্রতিবাদকে সামাজিকতা বিরোধী, ঐতিহ্য বিরোধী প্রতিপন্ন করা, সেনাবাহিনীকে জাতীয়তাবাদের প্রতীক, গণতন্ত্রের নামে ঐক্যমত্য হওয়াকে মুখ্য প্রতিপন্ন করা, জাতীয়তাবাদের নামে আসলে ধর্মীয় জাতীয়তার প্রচার, কিংবদন্তী বিপ্লবী চে গেভারা'র যাবতীয় ছবি ও চিহ্নাবশেষকে বাণিজ্যিক প্রতীক হিসেবে জামাকাপড় থেকে মায় জুতোয় পর্যন্ত ছাপিয়ে দেওয়া ইত্যাদি নানা কিছু। এমন হাজারো পরিকল্পনামাফিক নব নব প্রথা, মিথ, এবং কোড চালু করে সাধারণভাবে সমাজপটে মানুষের জ্ঞাপনভূমিকা অনেকাংশে নির্দিষ্ট করে দেওয়া গেছে। আর গত শতকের সত্তর দশক থেকে জ্ঞাপন প্রযুক্তির বিস্ফোরণ যেভাবে ঘটেছে তার নিত্য ব্যবহারের কৌশল এবং প্রযুক্তি পরিসরের ব্যবহারকর্মে ব্যস্ততা দিয়ে মানুষের স্বাভাবিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভূমিকা অনেকটাই নির্দিষ্ট করে দেওয়া গেছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আজ ভারতবর্ষের মতো দেশে একটি চলভাষ বা মোবাইল ফোন কেনা বা ব্যবহারের প্রয়োজনে অর্জন করার মতো জ্ঞানের পরিসর যত বেড়েছে এবং তাতে শ্রেণিবিন্যাসের উর্ধে মানুষের উৎসাহ যত বেড়ে চলেছে তাতে এক বড় সংখ্যার মানুষের ক্ষেত্রে জ্ঞাপন পরিসর ব্যবহারের মাত্রা নিরূপণ করে দেওয়া যায়। পাশাপাশি পড়ে থাকা এমন বিশাল চিরায়ত লোকদেশটাতে দারিদ্র্য, অভাবের বুকের উপর দাঁড়িয়েও ব্যয়ক্ষমতা বা অ্যাফোর্ডেবিলিটি কোড'এর নিরিখে এই চলভাষের দোসর হিসেবে শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, কফিশপ থেকে সমাজপটে আনুষঙ্গিক যত প্রতিষ্ঠান, ভাষাসংকেত এবং পরিসরের আকারে বিপুল অথচ বৈচিত্র্যে সীমাবদ্ধ কোডবিন্যাস দেখা যাচ্ছে তাতে উন্নত জ্ঞাপনকারীর সঙ্গে সঙ্গে অভাবী জ্ঞাপনকারীরও ব্যবহার-সংকেত, ভাষা-সংকেত এবং জ্ঞাপন-সংকেত অনেকটাই নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে।

আর এমন সীমাবদ্ধ পরিসীমার মধ্যে সাধারণ মানুষের যে পরিণতি অনিবার্যই ছিল তা হলো একদিকে জনমধ্যে এক মানবিক ভারচুয়ালিটি'র বিস্তার আর অন্যদিকে কিছু মানুষের ‘আমি’র বিপুল বিস্তার, যে বিস্তার সম্পূর্ণ সামাজিকঅর্থাৎ সামাজিক স্পেস সেই কয়েকটি বিশেষ ‘আমি’র বিস্তারে ব্যবহৃত হয়েছে আর সাধারণ ‘আমি’র বিস্তার ঘটেছে মুখ্যত ভারচুয়ালিটি’র নতুন পরিসরে যেখানে এতদিনের সামাজিক অসাম্যের ভারচুয়াল সমাধান ঘটেছেফলে এই বিস্তার আসলে মেধাভিত্তিক কল্পনার বিকাশ নয়, বাধ্যতামূলক কাল্পনিকতার বিস্তার যা এককথায় অনিবার্য ঠিক এইখানটিতেই অর্থাৎ এমন বিস্তারকে ধারণ করতে নতুন নতুন পরিসর'এর পসরা নিয়ে হাজির হলো 'পরিসর' বা 'স্পেস' ব্যবসায়ীগণ। প্রবল হুড়মুড়িয়ে, প্রায় গাদাগাদি করে মানুষ ঢুকে পড়ল কাল্পনিকতার বিস্তারকে একটা চেহারা দিতে। কেমন চেহারা? যেমনটি ওই 'পরিসর' কোম্পানি ফ্রেম করে রেখেছে সেই ফ্রেমে নিজেকে ফিট করে নিলেই হলো। আপন তথা অন্যের শিল্পকর্ম থেকে নিজের তথা অন্যের বিয়ের ছবি, আপন প্রোফাইলের নানাবিধ প্রকাশ থেকে আরম্ভ করে আপন-দর্শনের যাবতীয় রচনার নিদর্শন, রেস্তোরা'য় নিজের খাবারের ছবি প্রকাশ উৎসব থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অনিবার্যতা পর্যন্ত সবই এক নতুন চেহারা পেল এতে কোনো সন্দেহ নেই।

এইসঙ্গে দারুণ বিকশিত হলো বিশ্বজোড়া খবর বা সংবাদ পরিবেশন এবং সংবাদ গণমাধ্যম। গতশতকের সত্তর-আশি'র দশকে তথ্যখেকো বৃহৎ সংবাদসংস্থাসমূহ এবং বড়ো বড়ো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি সংবাদ তথ্য সরবরাহে দারুণ অসাম্যের প্রতিবাদে অনেকদূর অগ্রসর হয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘ পর্যন্ত গেলেও শেষপর্যন্ত অবশ্য গণমাধ্যমের বিশ্বায়নের চাপে সবাই আবার সবকিছু মেনেও নিল।

কিন্তু এত কিছুর মধ্যে যে বিষয়টি অথবা যা হারিয়ে গেল তা হলো সেই সাধারণের 'আমি'। আমি তাহলে 'কে' অর্থাৎ আমার পরিচয় 'কি'। এ শুধু আমার 'আমি'র কথা নয়, তোমার 'আমি'র কথাও। এ আসলে তো জ্ঞাপনকারী আর গ্রহীতা'র কথা নয়, দুই 'আমি' অথবা অনেক 'আমি'র পারস্পরিক গল্প। একদিকে এক 'আমি' কাজ করে, অন্যদিকে বাকি 'আমি'রা সেই 'আমি'কে দেখে, বিচার করেকীভাবে বিচার করে? 'তুমি' বলে, 'তুই' বলে, তোমরা, তোরা, এরা, ওরা, মানুষ, জনগণ ইত্যাদি নানা ভূষণে। তাই এমন ভূষণ কারুর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হতে পারে না। এ নিতান্তই উপাধির মতো, কোনোটা পছন্দের, কোনোটা সম্মানের, উপরের, আবার কোনোটা অপমানের, অপরাধের, নীচের, সাধারণের। এই উপাধি এমন এক শক্তি ধরে যা সবার 'আমি'কে হয় অনুপ্রাণিত করে অথবা বাধ্য অর্থাৎ অবদমিত করে। কিন্তু যাই ঘটুক না কেন, এই উপাধিকে ছাড়িয়ে যে কোনো সময় পরিসরে আমি'র 'অভিপ্রায়ের দ্বন্দ্ব'ই হলো সেই চরম অথচ দৈনন্দিন 'অবস্থা' যা অনুচ্চারিত থেকেও সর্বোচ্চমাত্রায় ক্রিয়াশীল। একে দাবিয়ে রাখার নাম শাসন, আর সেই দ্বন্দ্বকেই ভারচুয়ালিটি’র বদলে অ্যাকচুয়ালিটি’তে ফুটিয়ে তোলার নাম বিপ্লব। তা সে যেমন চেহারাতেই প্রকাশিত হোক না কেন।

তাই অভিপ্রায়ের 'দ্বন্দ্ব' তাই কোনো কোডশব্দ অথবা ধ্রুবশব্দ নয়, এইজগতে প্রত্যেকটি ঘটনা তথা ঘটনার বোঝাপড়ার নেপথ্যে রয়েছে অভিপ্রায়ের চিরায়ত দ্বন্দ্ব অনেক তাত্ত্বিক একে তাই দ্বন্দ্ব না বলে চিরাচরিত বিরোধিতা বলতেই পছন্দ করেন। তবু একে দ্বন্দ্ব বলতে হবে কারণ মানুষের অভিপ্রায়গুলো ঘটনাচক্রে বিশেষ সময় পরিসরে পরস্পর যেমন বিশিষ্টতা অর্জন করে তেমনি অভিপ্রায়ের সেই বিশিষ্টতার আদানপ্রদান করবেই। তাই এক অভিপ্রায় এই দ্বন্দ্বে প্রভাবশালী হয়ে উঠবে আর এক অভিপ্রায় এখানে শোষিত হবে। আবার কখনো এক অভিপ্রায়ের প্রকাশ বৈপ্লবিকভাবে সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠবে আর এক অভিপ্রায় বর্জিত হবেই। এই ঘটনা ঠিক-ভূল, কল্যাণকর-অকল্যাণকর সবক্ষেত্রেই ঘটে চলবে এবং ইতিহাসকেও ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে নিয়ে চলবে। তাই মুখ্য বিষয়টা ঘটনার ফল'এর নিরিখে নয় আসলে অভিপ্রায়ের নিরিখে বিচার্য হওয়াই অভিপ্রেত তা সে যত কঠিনই হোক না কেন। তাই এ আমার ‘আমি’র অভিপ্রায়ের বছর দশেকের ভাবনা এবং মুখ্যত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যর্থতার ফসল।

No comments:

Post a Comment