Saturday, April 21, 2018


গণমাধ্যম, বাজার এবং আমাদের সমকালীন আখ্যান



আবীর চট্টোপাধ্যায়

(লেখাটি চরৈবেতি পত্রিকায় প্রকাশিত)


গণমাধ্যম বা মিডিয়া, যে নামেই একে ডাকা হোক না কেন, বিশ্বব্যাপী আজ পর্যন্ত যত আখ্যান একে নিয়ে গড়ে উঠেছে বা একে বিভিন্নভাবে চিহ্নিত করার কাজ হয়েছে বা হয়ে চলেছে তার পরে গণমাধ্যম সম্পর্কে আজ নতুন করে কি আর কিছু বলার বা জানার বাকি আছে? অবশ্য এরও আগে যে প্রশ্নটি নিজেকে করা দরকার এই গণমাধ্যমের তথা সোশ্যাল মিডিয়ার বিশ্বব্যাপী বিস্তারকে আমরা কী চোখে দেখব? একইসঙ্গে ভারতবর্ষেও সেই বিশ্বগণমাধ্যমের বিস্তারকে কীভাবে বিচার করবো? প্রয়োজনীয় বিস্তার নাকি সাম্রাজ্যবাদী বিস্তার? নাকি দুইই? গণমাধ্যম তো শুধু তথ্যই দেয় না সংস্কৃতিও সৃজন করে। একে আমরা গ্রহণ করে চলেছি বিপুলভাবে। ফলে একে কি সভ্যতা তথা সংস্কৃতির বিকাশ বলা যাবে? যদি পুরোপুরি না বলা যায় তাহলেই কি বিকল্প সাংস্কৃতিক বিকাশকে প্রস্তুত করতে হবে? নাকি বিকল্প সাংস্কৃতিক ভাবনাও এই একই বাজারী গণমাধ্যমের আনুকুল্যেই মানুষের কাছে সম্প্রচার করতে হবে? তথ্যের প্রয়োজনীয়তা আর তথ্যের সাম্রাজ্যবাদী বিস্তার এই দুই বিষয়ের মধ্যে আমার তথা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কী কিছু বলার বা ভাবার আছে? তথ্য পাওয়া আমাদের 'অধিকার' নাকি এ এক ক্রয়যোগ্য পণ্য? গণমাধ্যম তথা তার সৃষ্ট সুশীল সমাজ এবং কলাকুশলী সমাজ এই দুই-এর বিপরীতে আমাদের অর্থাৎ সাধারণ মানুষের অবস্থান বা ভূমিকা কী? শুধুই দর্শক হিসেবে এনজয় করা? নাকি এদের নিয়ে কথা বলার বা বিশ্লেষণ করার অধিকার আমার আপনারও আছে? এইরকম অনেকগুলি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার তথ্যভিত্তিক নয়, বক্তব্যভিত্তিক চেষ্টা থাকবে এই লেখায়

গণমাধ্যমের আখ্যান

প্রথমেই বলে রাখি এই বিষয়ে আজ পর্যন্ত প্রকাশিত আখ্যানগুলি বা এই আখ্যান গণমাধ্যমকে শুধুই আমার-আপনার যোগাযোগের মাধ্যম বলে প্রতিষ্ঠা করে নিঅথবা 'প্রযুক্তির উন্নতির ফলে পৃথিবীটা ভূবনগ্রামে পরিণত হয়েছে' - এমন প্রাথমিক স্তরের কথা দিয়ে চিড়ে ভেজানোর লক্ষ্যেও আজ পর্যন্ত এত গবেষণা হয় নিএকদিকে প্রযুক্তি-নির্ভর আজকের বিশ্বগণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বা গ্লোবাল মিডিয়া আর অন্যদিকে সেই একই প্রযুক্তি এবং আর্থিক-প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অনুযায়ী সাধ্যমত প্রযুক্তি দিয়ে প্রস্তুত আমার দেশীয় গণমাধ্যম - এই দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে ভাবতে হচ্ছে এই গণমাধ্যম-বিশ্বে বা তথাকথিত ভূবনগ্রামে আমাদের সামাজিক ভবিষ্যত কি, আর সেই ভবিষ্যতের সম্ভাব্য আখ্যানটি কেমন হবে? একদিকে গ্লোবাল মিডিয়ার ক্ষমতা এবং বিস্তার নিয়ে যেমন আজ আর কারুর মনে সন্দেহের অবকাশ নেই, তেমনি অন্যদিকে সাধারণ জনজীবনে তাকে ব্যবহার করার নেপথ্যে তথ্যের এবং অজানা পৃথিবীটাকে জানার দারুণ প্রয়োজনীয়তা আমরা নিত্য অনুভব করে চলেছি। কারণ, ভারতের মতো দেশে সাম্প্রতিক সময়ে ভূবনায়িত গণমাধ্যম সংস্থাগুলির ঢেউ আছড়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে একদিকে তথ্যের স্রোত অন্যদিকে তথ্যের নামে আসলে বিভিন্ন সস্তা সাংস্কৃতিক দ্রব্য পণ্য হিসেবে মোবাইলে, কম্পিউটারে আমাদের জনজীবনকে প্রয়োজনের অনেক উর্ধ্বে শুধুমাত্র গ্রাহক হিসেবে লক্ষ্যবস্তু করে সরবরাহ করে চলেছে। পণ্য সরবরাহের এই বিশাল স্রোতের ফলে গণমাধ্যম তথা পরিসর-মাধ্যমের বাণিজ্যিকতা আজ এতটাই নিশ্চিত যে এর মধ্যে দিয়ে ভারতীয়পনা, দেশপ্রেমিকপনা সহ আরও যত দেশীয়পনা আছে সবরকম প্রকাশ করে চলেছে এবং জনগণও প্রবল উদ্যমে সেই সব ঐতিহ্যপনা গ্রহণ করে চলেছে আবার বিশ্বগণমাধ্যমের দেশীয় প্রতিনিধি হিসেবে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলি বেশ একটা স্বজাতীয় ভঙ্গীতে মানুষকে আকৃষ্ট করলেও অন্যদিকে তথ্য ও সংস্কৃতির প্রশ্নে বিশ্বায়িত মানসিকতার বিকাশ ঘটিয়ে চলেছেব্যাপারখানা যেন 'আপনি বর্তমানে কেমন আছেন এবং আপনার ভবিষ্যতের প্রকাশটি কেমন হওয়া উচিত' এমন একটি সংস্কৃতি আদর্শের নিরবচ্ছিন্ন এবং বহুবিধ প্রচারফলে সাধারণ মানুষ একদিকে যেমন নতুন আঙ্গিকে দেশীয় নানা বিষয়ের প্রদর্শন দেখে চলেছে অন্যদিকে একেবারে ঘরে বসে বিশ্বব্যাপী নানা বিষয়ের নানাবিধ নমুনা দেখে চলেছে। প্রয়োজনের নিরিখে কেউই একথা বলতে পারবে না যে সমকালে আমাদের জীবনে এর সত্যিই কোনো বিকল্প আছে। আবার দেশীয় প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমে নানা ঘটনার বিকৃত, অতিরঞ্জিত, মাত্রাতিরিক্ত প্রদর্শন নিয়ে সাধারণ মানুষ যথেষ্টই অবহিত। অতি সাধারণ মানুষও আজ বিভিন্ন মিডিয়ার রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে ঠিক-ভুল যাই হোক না কেন পাড়া, মহল্লায় একেবারে 'নিশ্চিত' হয়ে তর্ক করে চলেছেআর এই যাবতীয় বিষয় নিয়ে কার্যত দিস্তা দিস্তা সমালোচনামূলক লেখাও হয়ে চলেছে এবং আরও হবে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া পরিসরে নানা বিষয়ে কথা, ছোট, বড়ো লেখা (মুখ্যত সংগৃহীত), অজস্র উপদেশ, দর্শন, কবিতা, এবং ঢেউয়ের মতো জোকস-এর স্রোত - এইসব এতই বেশি চালাচালি হচ্ছে যে তাতে গ্রাহকরা গণমাধ্যম তথা সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে একদিকে যেমন অবহিত, অন্যদিকে তেমনি অত্যন্ত সচেতনভাবে এই পরিসরের গ্রাহক হয়ে ভূ-সামাজিকতার কঠিন লড়াইয়ের প্রতিনিধিত্ব করার কাজটিও সেরে ফেলতে চাইছেফলে গণমাধ্যম তথা সোশ্যাল মিডিয়া বর্তমান দেশীয় মিডিয়া বাজারে যেমনটি চলার ছিল তেমনভাবেই বিকশিত হয়ে চলেছে। এইভাবে গণমাধ্যম তথা সামাজিক পরিস্থিতিটাই যেন সামগ্রিকভাবে কিরকম গড়পড়তা হয়ে পড়ছে আর স্বভাবতই একে সমালোচনার পরিসরও ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে পড়ছে। হতদরিদ্র এবং নানা কারণে প্রান্তিক মানুষও গণমাধ্যমের মহা-ধারাবাহিক, ক্যুইজ, রিয়েলিটি শো-গুলি দেখে চট করে বুঝে ফেলছে যে, আসলে বড়লোক হলেও সেই মানুষগুলির জীবনেও ওঠা-পড়া আছে, কাজেই বুঝে যাচ্ছে যে জীবনে ভালো কিছু হওয়া না হওয়া, পাওয়া না-পাওয়া সবই নাকি আসলে ভাগ্যের খেলা, এবং এইভাবে সে সমাজের উঁচুতলা-নীচুতলা, চেয়ারের এধার-ওধার সবই কেমন যে যার অবস্থানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে স্বভাবতই দ্বন্দ্ব, বিরোধ, ফারাক বোঝানোর রাজনৈতিক তত্বগুলি কেমন যেন বেসুরো লাগতে শুরু করেছে। বুর্জোয়াতন্ত্র থেকে মধ্যভোগতন্ত্র হয়ে লুম্পেনতন্ত্রের পক্ষে তাই এ এক অত্যন্ত সুখের সময়।

এমত পরিস্থিতিতে রোজকার ঘটনাবলী এবং সে সংক্রান্ত প্রতিবেদন ধরে ধরে যদি আলোচনা করা যায় তাহলে কিছু বাজারী গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন আপনার মতের বা আদর্শের সপক্ষে যাবে আর কিছু গণমাধ্যমের প্রতিবেদন আপনার মতের বিপক্ষে যাবে। আবার কোনো একটি গণমাধ্যমের কিছু প্রতিবেদন আপনার মতের বা আদর্শের পক্ষে গেল তো বাকি বেশ কিছু প্রতিবেদন তার বিপক্ষে গেল। টেলিভিশনে কোনো একটি মেগা ধারাবাহিক আজ কোনো উপলক্ষ্যে মহাসপ্তাহ পালন করলো তো আর একটি ধারাবাহিক অন্য কোনো উপলক্ষ্য সৃজন করে মহাসপ্তাহ পালন করলোবাজারে একই ধরণের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্যের মতোগণমাধ্যমের বাজার ধরে রাখার প্রশ্নে এটাই গণমাধ্যম সংস্থাগুলির অন্যতম কৌশল এবং এইভাবে জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রেও তারা সাম্প্রতিক সময়ে বেশ সফলএর ফলে তথ্য-এলিট তথা সাংস্কৃতিক-এলিট মানুষজন ভোক্তা হিসেবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আর সাধারণ জনগণ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে আরও অনেকগুণ বেশি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আবার এই বাজারী গণমাধ্যমের একেবারে বিপরীতে বিশেষ আদর্শবাদী, বিকল্প রাজনৈতিক গণমাধ্যমগুলি কোনো মত বা আদর্শের পক্ষে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করে চলছে এবং এইভাবে মানুষের মধ্যে বিকল্প আদর্শেরও প্রচার করে চলছে - বিকল্প সামাজিকতার প্রশ্নে এ এক অতি প্রয়োজনীয় অবস্থানপ্রখ্যাত মার্কসবাদী তাত্বিক সি রাইট মিলস বিকল্প গণমাধ্যম সম্পর্কে যেমনটি বলেছিলেন যে এরা বাজারী গণমাধ্যমের বিকল্পে মানুষের আদর্শের প্রচার করে চলবে, আর বাজারী গণমাধ্যমের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এরা তথ্যের এবং সংস্কৃতির প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ করবেকিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বিকল্প ভাবনাবাদীরাও যে বাজারী গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তার দশচক্রে বিশেষভাবে প্রভাবিত। এ প্রসঙ্গে যে সহজ যুক্তিটা আমাদের এক্ষেত্রে এমন ভাবনাকে বৈধতা দিতে বিশেষ সাহায্য করে তা হলো 'বিশ্বব্যাপী ঘটনাবলীর ক্রমবিবর্তন পুঙ্খে পুঙ্খে জানতে হলে বাজারী গণমাধ্যমের শক্তি এবং পারদর্শিতাকে মানতেই হবে। এটাই বাস্তব। আর এই বাস্তবতার চক্রে ঘুরতে ঘুরতে বাজারী গণমাধ্যম এবং বিকল্প গণমাধ্যম দুই-ই আমাদের দৈনন্দিন সমৃদ্ধির কাজে লেগে চলেছে এটাও তো বাস্তব। রাজনৈতিক সচেতন একজন প্রাজ্ঞ মানুষ তাই রোজ এই দুই শ্রেণির গণমাধ্যম আস্বাদন করে থাকেন, কারণ বাস্তবতার নিরিখে তথ্যসমৃদ্ধ বা তথ্য-এলিট হওয়ার প্রয়োজনটা মেটাতে হবে। আবার অতি সাধারণ মানুষ এতসবের পরোয়া না করে পছন্দের কোনো গণমাধ্যম দেখে, শুনে বা পড়ে নিকটক্ষেত্রে তার মত-প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনটি মেটান। এই দুই ক্ষেত্রেই প্রয়োজনটা আসলে মেটে কি না তা ব্যক্তিসত্তার বিষয়, কারণ এক্ষেত্রে তারা দুজনেই প্রয়োগের দাবিসনদ পেশ করেন নিকট বা দূরের মানুষজনের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটানোর জন্য। তার মানে কি গণমাধ্যম ক্ষেত্রে আমরা স্বাভাবিকভাবেই উদারনৈতিক-বহুত্ববাদে বিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছি? উত্তরটা হয়তো ইতিবাচক, অন্তত দেশীয় বাজার এবং গণতন্ত্রের মহান প্রেক্ষিতে তো বটেই। উপরের এই অবতারণায় এ কথা ভেবে নেওয়া উচিত নয় যে কোনো মানুষকে একটি নির্দিষ্ট গণমাধ্যম ব্যবহারের কথাই বলা হয়েছে। সে আর এক সংকীর্ণতার সংকট তৈরী করবে। তবু গণমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সম্প্রচারিত তথ্য এবং তার আলোচিত ও প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টিভঙ্গী অর্থাৎ সংস্কৃতি দুইই গ্রহণ করতে হবে। একটি যদি আমাদের 'প্রয়োজন' হয়, আর একটি তাহলে বাধ্যতা।

তাহলে গণমাধ্যমের সাম্রাজ্যবাদী, প্রভাবশালী, বাজারী চরিত্রগুলি নিয়ে সমালোচনার কি হবে? অর্থাৎ কীভাবে হবে? "খারাপ প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে প্রতিবাদ আর ভালো প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে প্রচারভিত্তিক সমর্থন" - এই কি তাহলে গণমাধ্যম সম্পর্কে আমাদের ভাবনার সীমা? ধরুন, ধারাবাহিকভাবে সরকারের বিপক্ষে অর্থাৎ সরকারের নানাবিধ ব্যর্থতার খবর করে যাওয়া একটি বাজারী গণমাধ্যম (বিকল্প রাজনৈতিক গণমাধ্যম নয়, কারণ তার খবরের অভিমুখ খুবই নির্দিষ্ট এবং প্রকাশিত) হঠাৎ সেই সরকারেরই পক্ষ নিয়ে খবরের নতুন ধারা সৃষ্টি করলে আমরা অবাক হওয়ার পরিবর্তে তার হকিকৎ বুঝে যাই সহজেই তখন আমাদের মধ্যে অনেকে সেই গণমাধ্যম দেখা বা পড়া বর্জন করি, অনেকে নতুন তথ্য জানার জন্য এতৎসত্ত্বেও ব্যবহার করি, আবার অনেকে নিয়মিত ব্যবহার বন্ধ করে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সেই গণমাধ্যম ব্যবহার করি। কিন্তু বাজারী গণমাধ্যমের এহেন চালাকি বোঝার ক্ষেত্রে আমরাও যে দারুণ পারদর্শী হয়ে উঠলাম সেও কি আমাদের বাকি আধপেটা, অপুষ্টি, ও দুর্নীতিতে ভোগা সামাজিকতার পক্ষে মঙ্গলকর? সে যাইহোক না কেন, এ প্রসঙ্গে মালিকপক্ষ, এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক শক্তির বোঝাপড়া ছাড়াও আরও কয়েকটি অভিজ্ঞতা স্তর থেকে যায়এক, সেই খবর-মাধ্যম কিন্তু যেভাবেই হোক এটাই প্রতিষ্ঠা করবে যে তারা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদই পরিবেশন করে। তাহলে কী দাঁড়ালো? অমীমাংসিত? নাকি যেমনটি উত্তর-আধুনিকতাবাদীরা বলেন এ এক স্বাভাবিক মাধ্যম-জনগণ বিচ্ছিন্নতা? দুই, অন্যদিকে আমরাও আবার 'বাজারের' এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে বিচরণ করে মাধ্যমগুলির জনপ্রিয়তা নির্দিষ্ট করি এমনকি নিকটজনের কাছে ফেরি করে বেড়াই কোন গণমাধ্যমের টিআরপি কত এবং সেই টিআরপি-র বলে সে কতো সমৃদ্ধ বা উন্নত, এছাড়া কোন সিনেমা কত কোটি টাকার ব্যবসা করলো - এ জাতীয় কর্পোরেট বাণিজ্যিক শর্তগুলি যখন আমার ভোগ নিবৃত্তি করে তখন বুঝতেই হয় এই বাজারে গণমাধ্যমের জনপ্রিয়তা ফেরি করে বেড়ানোটা সার্থক। অথচ গণমাধ্যম কিন্তু এক আঙ্গিকে তথ্য পরিবেশন করতে করতে তার বাণিজ্যের গতিমুখ আঙ্গিক-এর বদল ঘটাতেই পারেকাজেই প্রশ্নটা হলো আমরাও সেই বাণিজ্যের এক গতিমুখ থেকে অন্যগতিমুখে বিচরণ করছি। কেন?

পাশাপাশি গণমাধ্যমের যে বাজারী-ভোগবাদী চরিত্র নিয়ে বিদ্দ্বৎমহলে আমরা এত বেশি ভাবিত, সেই চরিত্রই যে আসলে গণমাধ্যমের বিশ্বায়িত চরিত্র যা তথ্য সম্প্রচারের প্রশ্নে আমাদের চাহিদা একদিকে যেমন ক্রমাগত বাড়িয়ে তুলেছে অন্যদিকে সেই চাহিদাকে যেমন খুশি প্যাকেজ বা মোড়কে পেশ করছে আমাদেরই মুখের সামনে। তবে আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের বাজারী-ভোগবাদী চেহারাটা যত না কর্পোরেটসুলভ তার চেয়ে অনেক বেশী প্রাতিষ্ঠানিকতার বশংবদবলা বাহুল্য, এই প্রাতিষ্ঠানিকতার সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে বুর্জোয়া-রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকতা যার হাতে ধর্ম, অর্থ, আর মানুষের অন্ধ-অচেতনতা-র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এই তিন ধারার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কাজটি সম্পন্ন হয়ে চলেছে গণমাধ্যমের সৌজন্যে, একথাও আমরা সবাই জানি।

প্রয়োজনীয় খবর-গণমাধ্যম বা তথ্য-গণমাধ্যম

বাজারী গণমাধ্যম কেন প্রয়োজনীয়? কারণ, তারা আর্থিক সামর্থের জোরে গোটা পৃথিবীটাকে, অবশ্যই নিজের ইচ্ছেমত, আমার আপনার ঘরে পৌঁছে দিতে পারে। ফলে যাদের এত ক্ষমতা সেই গণমাধ্যম নিজের এবং কাছের প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষমতার দম্ভ'ও প্রচার করতে পারেআবার কখনো কখনো সেই একই বাজারী প্রয়োজনেই বিকল্প আদর্শকেও প্রচার করতে পারেবিশেষত নির্বাচনের সময় আমরা দেখেছি বাণিজ্যিক ভারসাম্যের তাগিদে বিকল্প সামাজিকতার রাজনৈতিক বক্তব্যগুলিকেও যৎকিঞ্চিৎ সম্প্রচার করে

এখন প্রশ্ন হলো কীভাবে সম্প্রচার করে? প্রতিবেদনের ভাষা সৃজন করেস্বভাবতই গণমাধ্যম-নিয়ন্ত্রিত বাজারে এই ভাষা এতই শক্তিশালী অথচ বুর্জোয়া প্রাতিষ্ঠানিকতার অধীন যে, তা বৃহৎ বুর্জোয়াতন্ত্রের দোসর হয়ে বিকল্প বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যম এবং তার প্রতিবেদনকেও ছাপিয়ে যায় তাই শুধু প্রযুক্তি আর অর্থ ব্যবহার করে একটা বিকল্প গণমাধ্যম তৈরী করলেই বাজারী গণমাধ্যমের বিকল্প তৈরী করা বেশ কঠিন প্রযুক্তি, লগ্নিযোগ্য অর্থ, পেশাদারী মান আর সর্বোপরি এক অতিগোপন সম্পাদনা-পরিকল্পনার ছক এই সবকিছু উপাদানের বাজার সৃষ্টি করে তবে নয়া-উদারনীতিবাদ মুখ্যত তৃতীয় বিশ্বে গণমাধ্যম এবং সংস্কৃতির বিশ্বায়নে নেমেছে। কাজেই খাতায় কলমে বিকল্প প্রকাশ্য বা প্রকাশিত 'আদর্শ'-এর গণমাধ্যম সৃষ্টির সম্ভাবনা যে কোনো সময়ে বাস্তব মনে হলেও আসলে তা বড়ই কঠিন। আর ঠিক এই কারণেই গণমাধ্যম তথা বাজারী গণমাধ্যম বুর্জোয়া প্রাতিষ্ঠানিকতার এত কাছের। বুদ্ধিমান পাঠকের কাছে এমন গণমাধ্যম-প্রতিষ্ঠানসমূহের উদাহরণ দিয়ে নিজে আর বিব্রত হলাম না

যাই হোক, গত সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনী প্রচারে যে অভূতপূর্ব গতিতে "আচ্ছে দিন"-এর বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছিল তার রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে সাধারণ মনে আজ আর তেমন কোনো সংশয় নেই। কেন নেই? কারণ আমরা দেখলাম গত তিন বছরে এই সরকারটির গড়পড়তা কিছু যোজনাভিত্তিক ঘোষণা আর 'বিপ'-রক্ষা বা গণতন্ত্র রক্ষার প্রহসন। অর্থাৎ মুখ্যত গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের সেই প্রচারের নেতিবাচক ফল। আচ্ছা, এখন ধরা যাক, যদি ফলাফল খানিকটা অন্যরকম হতো অর্থাৎ দেশে উন্নয়ন যদি সত্যই হতো, অথবা শাসকদলের তরফে সাফল্যকে যেভাবে আবার ব্যাখ্যা করা হচ্ছে তা যদি সত্য হতো তাহলেও কি এই আধপেটা মানুষের দেশে সেই প্রাকনির্বাচনী বিজ্ঞাপনের ঝড় সার্থক হয়ে উঠত? সরকার তথা শাসকের এই দাবিটাই আজকের সবচেয়ে বড়ো বিপদের কথা তাই কয়েক মাসে কয়েক-শো কোটি টাকা খরচ করে দেশব্যাপী সেই বিজ্ঞাপনের ধারাবাহিকতাকে যদি কয়েকবছর পরের মেকি ফলাফল বিচার করে তবে সমালোচনা করতে হয় তাহলে তো ওই ভয়াবহ 'কারণ'টিকে আমরা সমালোচনা করলাম না, বা কাঠগড়ায় দাঁড় করালাম না, যা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে শুধু ভবিষ্যতের আষাঢ়ে গপ্পো ফাঁদতে পারে। দুই, যেভাবে এই বিজ্ঞাপনটি সাধারণ মানুষের শ্রেণি চরিত্রের আবহে সৃষ্টি করা হলো, দেখা গেল তা সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের অসাম্যকে আড়াআড়ি ভেঙ্গে ফেলল। অর্থাৎ সর্বস্তরে শ্রেণি অবস্থানকে কৌশলে পৃথকভাবে ব্যবহার করিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হলো 'আচ্ছে দিন'-এর সম্ভাবনা।

এই পর্যায়ে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, যে এর বিকল্পে পাল্টা বিজ্ঞাপন হলেই লড়াই জমত। আর এ কাজ তো অতীতে হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি কি এতই সাধারণ? না। গণমাধ্যমের যে বাজারী অস্তিত্বের কথা এতক্ষণ বলছি সেখানে শুধু প্রতিবেদন বা বিজ্ঞাপনের ক্যাপসুল তৈরী করে অর্থ বিনিয়োগ করলেই হবে না, গণমাধ্যমের বাজারী প্রাসঙ্গিকতার বিষয়টি এখানে প্রধান শর্ত যেখানে এক বুর্জোয়াতন্ত্রের বিরোধী আর এক বুর্জোয়াতন্ত্র চলতে পারে বা সাম্প্রদায়িক লুম্পেন সংস্কৃতিও চলতে পারে কিন্তু সামাজিক প্রশ্নে বিকল্প মতাদর্শ সম্প্রচারিত হলেই ঠিক সেই বাজারী চরিত্রের বিকল্প হয়েই প্রতিষ্ঠিত হবে এমনটা এই কর্পোরেট বিশ্বায়নের যুগে জোর করে বলা যায় না, অন্তত অভিজ্ঞতা তেমন সায় দেয় না। এখানে দুটি বিষয়কে ভাবতে হবে, এক, বিকল্প গণমাধ্যমে তথাকথিত 'বাজারী' (যাকে অনেক ক্ষেত্রেই পেশাদারী বলে মনে করা হয় এবং প্রচারও করা হয়) ভঙ্গীতে তথ্য ও সংস্কৃতির প্রচার কৌশল অবলম্বন করা আর, দুই, বাজারী গণমাধ্যমে বিকল্প ভাবনার প্রচার, যা কার্যত গণমাধ্যম কর্পোরেটের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে কাজেই এবার বাজারী গণমাধ্যম যাতে তেমন তথ্য খবর হিসেবে প্রকাশ করে সেই সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সেই মতাদর্শের প্রকাশকে যথেষ্ট পরিমাণ লঘু করে দেখাতে হবে। বাজারী গণমাধ্যমে বিশেষত নির্বাচনের প্রচারকালে নিজেদের অবস্থানকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রচারে এবং বিজ্ঞাপনে তেমন লঘুপনাও প্রায়শই চোখে পড়ছে।

কাজেই গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তাকে বিচার করতে হলে প্রতিষ্ঠানগত, প্রযুক্তিগত এবং অর্থগত ক্ষমতার আঙ্গিকে বিচার করতে গেলে 'বাজারী' এবং 'বিকল্প'-এর ফারাকটা গুলিয়ে যেতে পারে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিকতার নিরিখে চলতি বাজারী গণমাধ্যম-প্রতিষ্ঠানগুলি এখন এতই প্রয়োজনীয় যে মানুষের কাছে পৌছনোর ক্ষেত্রে যে কোনো রাজনৈতিক, ভূসামাজিক যোগাযোগ, জ্ঞাপন, আদানপ্রদান, মতবিনিময় এবং তার নিত্য অভিনবত্বও তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। অভিনবত্ব বলতে শুধু বাজারী কর্পোরেট গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া পরিসর সংস্থাগুলিকেই বোঝানো হচ্ছেপ্রযুক্তি তথা আপন পরিসরের চেয়েও কোনো প্রতিষ্ঠানের গণমাধ্যম তথা সোশ্যাল মিডিয়া পরিসর আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একথা পরে আরও বিশ্লেষণ করতে হবে। কাজেই একথা বুঝে নিতেই হবে আসলে আমি/আমরা নিজেরাই নিজেদের বিকল্প সামাজিকতা এবং গণমাধ্যমের গুরুত্ব খাটো করে দেখছি, যেহেতু বাজারী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এবং সোশ্যাল মিডিয়া পরিসর ক্রমাগত আর্থিক এবং রাজনৈতিক শক্তিবৃদ্ধি করে চলেছে যার ফলে আজ গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে বৃহৎ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এবং তাদের মালিক প্রতিষ্ঠানগুলি কোনো না কোনো বুর্জোয়া রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে অনুসরণ করাই প্রাথমিক কর্তব্য মনে করছেবিকল্প রাজনীতির বদলে বিকল্প বুর্জোয়াতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাকেই অতি মহৎ কর্তব্য বলে মনে করছে। এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে আর এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এক মন্তব্য থেকে আর এক মন্তব্য, এক ঘোষণা থেকে আর এক ঘোষণা, এক যোজনা থেকে আর এক যোজনা - বাজারী গণমাধ্যম প্রচারযন্ত্রগুলির এক মুখ থেকে আর মুখে সম্প্রচার হয়ে চলেছে। আর চলেছে অনাথের মতো পড়ে থাকা সমাজ পরিসরগুলিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রমোটারের দলভুক্ত হয়ে মানুষের পরস্পরের অসহায় গোষ্ঠী সংঘর্ষ এবং হানাহানিএরও পিছনে থেকে যায় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথা নিয়ে আন্দোলন করা রাজনৈতিক দলগুলি, যাদের খবর বাজারী গণমাধ্যমে জায়গা পায় না, আসলে সরাসরি উপেক্ষিত হয়আর দর্শক জনগণ একদিকে যেমন প্রাতিষ্ঠানিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন, অন্যদিকে দর্শক-শ্রোতা-পাঠক হিসেবে চিরসংশ্লিষ্টকাজেই এর মধ্যেও আমার যা কিছু বিকল্প তাকে এমন উপেক্ষার মধ্যেও বাঁচিয়ে রাখতে হবে এবং তা মোটেই লঘু করে, প্রচারযোগ্য করে নয়

সংস্কৃতির গণমাধ্যম বনাম গণমাধ্যমের সংস্কৃতি

এ তো গেল খবর সংক্রান্ত গণমাধ্যমের কথা। গণমাধ্যমবিশ্বে খবরই গণমাধ্যমের একমাত্র উৎপাদন নয়সারা বিশ্বে গণমাধ্যমের মুখ্য উৎপাদনক্ষেত্র হলো সংস্কৃতিক্ষেত্র। এই সংস্কৃতিক্ষেত্র মানে সংস্কৃতি-পরিবেশনাক্ষেত্র বা 'গান-বাজনা-নাটক'-ক্ষেত্র নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে জ্ঞাপন বা মত আদানপ্রদানকে প্রভাবিত এবং উৎপাদন করার লক্ষ্যেই গণমাধ্যমের বিশ্বব্যাপী বিচরণ এবং অবশ্যই ব্যবসা কার ব্যবসা? যে মালিক, তার ব্যবসা? কিসের ব্যবসা? মত বা ওপিনিয়ন প্রতিষ্ঠার ব্যবসা। আমরা সেই নাটকীয় সম্প্রচার দেখে বিনোদনের নামে আসলে তাকে বৈধতা প্রদান করিকে বা কারা এমন মত-প্রতিষ্ঠা সম্প্রচারকারী গণমাধ্যমের মালিক? দেশীয় কেউ? নাকি বিদেশী? আমরা এর কতটুকু জানি? জানি কি 'স্টার' টেলিভিশনের মালিক কে? যদি জেনেও থাকি তা কি সাধারণ জ্ঞান হিসেবে, নাকি তার চেয়ে একটু বেশি কোনো প্রয়োজনে? যত অনুষ্ঠান গণমাধ্যমে সম্প্রচারিত হয় তার দায় কার - গণমাধ্যমের নাকি যে প্রতিষ্ঠানটি (যাকে বলে প্রোডাকশন হাউস) এমন অনুষ্ঠান তৈরী করে? নাকি এই দায় দুজনেরই? এমন বহু প্রশ্ন আজ প্রাসঙ্গিক হয়েও প্রান্তিক হয়ে অনাদরে পড়ে আছে। যে টেলিভিশন চ্যানেল আজ আমাকে বিশ্ব-ফুটবল সম্প্রচার করে মনোরঞ্জন করল সে অন্য সময়পর্বে ওই একই পরিসরে রিয়েলিটি শো-এর নামে অবাধ সাংস্কৃতিক-ভোগ পণ্য হিসেবে সম্প্রচার করলো, যা ধারাবাহিকভাবে আমার যাবতীয় সামাজিকতার লড়াইকে অপ্রাসঙ্গিক করে শো-এর বিতর্ককেই প্রাধান্য দিলআবার আমরাই এই ধরণের সমালোচনাকে অবান্তর প্রমাণ করে নিজেরাই প্রমাণ করলাম 'বিষয়টা যেমনই হোক রিয়েলিটি শো-তে তর্কাতর্কি, ঝামেলা, মারামারিগুলো কিন্তু হেব্বি জমেছিল'এরও পরে অর্থাৎ তৃতীয় পর্যায়ে সমাজের বিত্তশালী, সুশীলতর এলিট মানুষ আমাদেরই উদ্দেশে বলেন 'আসলে এক্সপোজার কম তো তাই বিষয়টা বুঝতেই পারে নি'

যাই হোক এমন জটিলতার মধ্যেও যে বিষয়টি উপরের সব প্রশ্নগুলির বাস্তবতা স্বীকার করে তা হলো বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের মালিকানার ঘনীভবনসারা পৃথিবীর সিংহভাগ গণমাধ্যম সাকুল্যে দশ-বারোটি গণমাধ্যম কোম্পানির মালিকানার অধীনে চলে এসেছে। এক একটি কর্পোরেশন রেডিও - বিশেষত এফ এম রেডিও, টেলিভিশন, বই প্রকাশনা সংস্থা, সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান, বিনোদন পার্ক, ইন্টারনেট পরিকাঠামো, সিনেমা নির্মাণ কোম্পানি, সিনেমা পরিবেশনা কোম্পানি প্রভৃতি যাবতীয় মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের মালিক। যেমন, AOL-টাইম-ওয়ার্নার, ওয়াল্ট ডিজনী কর্পোরেশন, তথ্য-দস্যু রূপার্ট মারডকের নিউজ কর্পোরেশন, সোনি ইন্টারন্যাশনাল, ভায়াকম, ভিভেন্দি ইন্টারন্যাশনাল, জেনারেল ইলেকট্রিক প্রভৃতি গণমাধ্যম কংলোমারেট সংস্থা গোটা পৃথিবীর গণমাধ্যম বাজার দখল করে রয়েছে। এদের সঙ্গে জুড়ে থাকা বিভিন্ন দেশীয় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলি হয় পূর্ণমাত্রায় নাহয় আংশিকভাবে সংযুক্ত হয়ে আছে, যে সাম্রাজ্যবাদী বিস্তার সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে ঘটে চলেছেঅন্তত ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক গণমাধ্যম বাজারটি এমনভাবেই দখল হয়েছে।

এর পাশাপাশি দারুণ গতিতে গজিয়ে উঠেছে মেগা-ধারাবাহিক প্রযোজনা বা নির্মাণকারী সংস্থাগুলি যারা গণমাধ্যমের পরিসর কিনে ধারাবাহিকভাবে আমার-আমাদের সংস্কৃতির নির্মাণ এবং পুনর্নির্মাণ ঘটিয়ে চলেছে কারণ সামাজিক ক্ষেত্রে জ্ঞাপন বা ভাবনা আদানপ্রদানের মাধ্যমে যে ঘটনা ঘটে তার আখ্যান নির্মাণ করে তারপর মেগা-ধারাবাহিকগুলিতে তারই বারংবার পুনর্নির্মাণ ঘটিয়ে সামগ্রিকভাবে সংস্কৃতির নির্মাণের একচ্ছত্র দাবিদার হয়ে উঠেছে গণমাধ্যম সংস্থারই সৃষ্টি করা 'পরিবার'গুলি যারা আবার নিজেরাই নিজেদের জনপ্রিয়তার পুরস্কার দিয়ে বিনোদনের বৃত্তটি সম্পূর্ণ করেছে। মহাজাতিক গণমাধ্যম কংলোমারেটগুলি শুধু মেগাধারাবাহিক সম্প্রচার করার উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে ব্যবসা ফেঁদে বসেছেআর এর পরেও নতুন যারা আছে অর্থাৎ নতুন ধারাবাহিক প্রোডাকশন কর্তাদের কাজ হলো সেই বৃত্তটিতেই ছোটো ছেলে-মেয়ের মতো হাত বুলিয়ে হাত পাকিয়ে নেওয়া। এত কথার অবতারণা করলাম কারণ এদের সঙ্গে বুর্জোয়া তথা আঞ্চলিক ক্ষমতা কেন্দ্রের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। এ কোনো সাধারণ যোগাযোগ নয়, জনগণ এবং জনমত-কে একদিকে বাজারের পক্ষে অন্যদিকে সরকার নামক প্রতিষ্ঠানটিকে সমালোচনা-বিরোধিতার হাত থেকে মুক্ত করতে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করাই এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য। একথা আমরা জানিও বটে, আবার জানি নাও বটে। জানি, কারণ শুনেছি বা দেখেছি, আবার জানি না, কারণ আমি যে আসলে নিয়ন্ত্রিত তা মানতে আমি নারাজ। আবার আমাদেরই উপর ভবিষ্যতের ইতিহাস সৃষ্টি করার ভার সবাই অর্পণ করে রেখেছে - সে দায়ও আমাদেরই বহন করে যেতে হবে এক নির্বাচন থেকে আর এক নির্বাচনে। কিন্তু আমার/আমাদের নিজেদের দশা, নিজের কথা কাকে বলব? সবাই তো একদিকে তথ্য আর অন্যদিকে সংস্কৃতির নতুন বিতর্কে মজে আছে, বিভিন্ন গণমাধ্যম চ্যানেলে প্রতি সন্ধ্যার বিতর্কসভায় আর পরপর মেগা-ধারাবাহিকেসেখানে আমার প্রতিনিধি আছে তো, সে যে বিষয়ে বলবে সেটাই আমার বিষয়, আর যা বলবে, সেটাই তো আমার কথাউনবিংশ শতকে উপনিবেশের যুগের মতো তৈরী হয়েছে ইউরোপের নামী ক্লাবগুলির এদেশীয় ফ্যান-ফলোয়িং তাহলে আমার নিজের কথা কোনটা? আমাদের দেখা সমাজের, না কি বাজারী গণমাধ্যমের দেখা সমাজের? যদি এর মধ্যে একটা বাছেন তাহলে একরকম মেরুকরণ হলো কিন্তু যদি দুটোই বাছেন তাহলে ভোগের প্রয়োজন অনুযায়ী হলোসেই প্রয়োজন নিত্যদিনের হিসেবে আমাকে আপনাকে বিচার করে তবে বেছে নিতে হবে। এও কি করা সম্ভব? আবার বিনা সংশয়ে সারা বছর ধরে সেই আমিই যখন 'সংগৃহীত' বলে লেখাগুলিকে আমার 'মত' হিসেবে বৈধতা দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্রোতের মতো শেয়ার করতে থাকি, সে সবই কি তবে আমার কথা? তাহলেও বটে আবার নাহলেও বটে, এই সংগৃহীতের চাপে তো আমার নিজের কথাই আসলে হারিয়ে যাচ্ছে কোনো না কোনো লেখা ভাইরাল করতে গিয়ে।

গণমাধ্যমের 'পণ্য' কি?

গণমাধ্যম এমন এক পরিসর সৃষ্টি করে, যা বাজারী প্রয়োজনে 'সময় বিচার' করে বিক্রি করে। আর দ্বিতীয়ত, এক অভূতপূর্ব 'ভোগ' উৎপাদন করে যাকে কেনা এবং উপভোগ করাটা এখন সামাজিকক্ষেত্রে মুখ্য দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। টেলিভিশন থেকে রেডিও, মোবাইল থেকে কম্পিউটার সর্বত্র একদিকে 'পরিসর' অন্যদিকে 'ভোগ' এই দুই পণ্য দিয়ে পৃথিবীটাকে প্রায় মুড়ে ফেলেছে। এই পরিসর পণ্য এবং ভোগ পণ্যের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে সে অনুষ্ঠান নামক পণ্য সম্প্রচার করে। মজার ব্যাপার হলো গণমাধ্যমের 'পরিসর' পণ্যটি দখল করলো বড় বড় প্রোডাকশন হাউস এবং বড় শিল্প-কর্পোরেশনগুলি। আর 'ভোগ' নামক পণ্যটি বরাদ্দ হলো আমাদের মতো সাধারণের জন্য। প্রাথমিকভাবে 'পণ্য' হিসেবে ক্রয় করো তারপরে উপভোগ করে ফুরিয়ে ফেল - যাকে ফরাসী তাত্বিক জঁ বদ্রীলার বলছেন 'সাম্পচুয়ারি ভ্যালু' বা 'ফুরিয়ে ফেলার' মূল্য। আমাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক মহাকাব্য উৎপাদনের জায়গা হলো আমাদের জ্ঞাপনক্ষেত্র বা জনক্ষেত্র যাকে জার্মান মার্কসবাদী তাত্বিক ইউরগেন হেবারমাস বলছেন জনক্ষেত্র বা পাবলিক স্ফিয়ার। আমাদের ভোগের নিরিখে সেই উৎপাদন ক্ষেত্র আজ সততই পিছনের সারিতে। অথচ আমরা কিন্তু স্বভাবমতো পরিসর খুঁজে চলেছি গণমাধ্যমের পরিসরের মধ্যে, অন্তত আমাদের গণমাধ্যম ব্যবহারের মাত্রা তো সেইদিকেই ইঙ্গিত করছে কিন্তু যে পরিসর সম্পূর্ণভাবে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে তা আমরা ব্যবহার করবো কি করে? বিকল্প মাধ্যমে? সেখানে কর্পোরেট হাউসের তেমন নজর পড়ার কথা নয়।

এমতাবস্থায় প্রয়োজন বুঝে সেই ইন্টারনেট দুনিয়ায় মাধ্যম-পরিসরকেই (mediated space) নতুন ধারার 'পণ্য' করে এগিয়ে এল নতুন নতুন সংস্থা। বৃহৎ শিল্পসংস্থাগুলির বিজ্ঞাপননির্ভর হয়ে জনগণকে প্রায় নিঃখরচায় (ডাটা পরিসরের দামে) পণ্য হিসেবে সরবরাহ করলো সেই পরিসর। সামাজিক জ্ঞাপন-ক্ষেত্রের একেবারে প্রতিস্থাপক হয়ে একদিকে 'পরিসর' পণ্য অন্যদিকে 'ভোগ' পণ্য দুইই দুর্বার গতিতে প্রবাহিত হলো জনগণের দিকে। এই দুই পণ্য মিলে সামগ্রিকভাবে সৃষ্টি হলো নতুন এক সমাজ প্রক্রিয়া এবং প্রকরণের যাকে সবাই সোশ্যাল মিডিয়া বলে মেনে নিলেন সৃষ্টি হলো দ্বিতীয় প্রজন্মের গণমাধ্যমের, যাকে মোটেই আর গণমাধ্যম বলা যাচ্ছে না কারণ এর কোনো খবর বা তথ্য সৃজনের দায় নেই এ শুধু 'পরিসর' এবং 'ভোগ' এই দুই বিমূর্ত 'পণ্য'কে আমার আপনার ব্যবহারের জন্য সৃজন করে চলেছেআর জনগণ কীভাবে তা গ্রহণ করেছে তা বলার জন্য এই লেখায় বাড়তি শব্দ না খরচ করলেও চলবে।

যাই হোক শুধু ভারতবর্ষেই সমকালে কোটি কোটি মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতি মুহুর্তে নিজেকে নতুন নতুন আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। সামাজিক পরিসরে নানা প্রথা, বিধিনিষেধের জন্য যা যা করা, বলা হয়ে ওঠে নি, অথবা অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক এমনকি বলেও সফলতা বা সুফল পাওয়া যায় নি, এখন গ্রাহক হিসেবে অজানা কারুর বানানো 'মিমস' ব্যবহার করে একটি বার্তা সৃজন করে পোষ্ট করা খুবই সহজলভ্য হয়ে উঠেছেএতে কি হলো? সার্বিকভাবে সৌজন্য, সচেতনতা কতটা বাড়ল সে তো পরের কথা, আপনি এই পোষ্টের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় উপস্থিতও রইলেন আবার একইসাথে মুখ্যত অনুপস্থিতও রইলেন আপনার বাকি সামাজিকতার নিরিখে। অর্থাৎ সামাজিক পরিসরে আপনি যেমনটি ছিলেন তেমনটিই রইলেন - আবার আপনার ছবিতে, ডিপি-তে, পোষ্ট-এ, লাইক-এ, শেয়ার-এ আপনি কতটা মাধ্যম-সক্রিয় সেটা বুঝিয়ে দিলেন। এইভাবে আপনি সামাজিকভাবেও কতটা সক্রিয় তা এতকাল যদি প্রতিষ্ঠা করতে নাও পারেন এবার সহজেই পেরে গেলেন লাইক, কমেন্ট, শেয়ার অস্ত্র প্রয়োগ করে। ঝুলন গোস্বামী বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে দুটি উইকেট নেবার সাথে সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ট্যুইটে শুভেচ্ছাবার্তা গণমাধ্যমের পর্দায় ভেসে উঠল। প্রযুক্তির সাহায্যে নব-পরিসরে তাঁর প্রচার হলোগণমাধ্যম না দেখালেও একই অধিকারে এবং একই পরিসর ব্যবহার করার ফলে আপনিও ঝুলনের উদ্দেশে শুভেচ্ছা জানালেন, এবং উপস্থিত রইলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। আপনারা দুজনে এবং আরও অনেকে ব্যক্তিগতভাবে একই সমতলে একই কাজ করলেনএইখানে সোশ্যাল মিডিয়া আপনাকে একটা নতুন অধিকারের না হোক অন্তত উপস্থিতির স্বাদ দিচ্ছে এতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু এই নতুন পরিসরে আমার আপনার এমন নতুন উপস্থিতি আমাদের কী দিল? গ্রাহক-পরিসর দিল, অনেকের সাথে নতুন যোগাযোগ দিল, অচেনা মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে, একথা মাউসের একটি ক্লিকে নিশ্চিত করে দিল - এইভাবে পণ্যের অতিরিক্ত এতগুলো নতুন মূল্য দিল যেগুলো ওই মাধ্যম-পরিসর ক্ষেত্র ছাড়া ভূসামাজিক ক্ষেত্রে তেমন ব্যবহারযোগ্যই নয়। একমাত্র সাইবার ক্রাইম করলে বা মৌলবাদী কাজকর্মই সমাজক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত মূল্য-কে পরিপূর্ণ ব্যবহার করে চলেছে পুরোমাত্রায়। আর আমি, আপনি কি করছি? আমরাও আমাদের সামাজিকতার প্রতিফলন ঘটাচ্ছি। আর এভাবেই কি নতুন করে 'দ্বন্দ্ব' সৃষ্টি হচ্ছে? বা সামাজিক পরিসরে চিরায়ত দ্বন্দ্বের প্রতিফলন হচ্ছে? সম্ভবত নাবিরোধের এক সমান্তরাল পরিসর যদিও বা তৈরী হচ্ছে কিন্তু এই অতিসামাজিক ভিডিও, জোকস সহ বিপুল ভোগ-পণ্যের আবহে সেই বিরোধও তেমন দানা বাঁধছে না

তাহলে কেউ কেউ বলবেন বাংলাদেশে বা ভারতেও কিছু কিছু জায়গায় স্বাধীন ভাবনাবাদী ব্লগলেখকদের এমন পরিণতি হচ্ছে কেন? প্রথমত, ব্লগ লেখনিতে পরিসর কোম্পানির আপন উপস্থিতি তেমন চোখে পড়ে না। দ্বিতীয়ত, সে দেশে মাধ্যম পরিসরের পাশাপাশি ভূসামাজিক স্তরে মৌলবাদের বাড়বাড়ন্তটা দেখুন। আমাদের ভারতবর্ষের ভবিষ্যত কি আমরা যতই আন্দাজ করি না কেন, অমন বিকৃত ফ্যাসিস্ট চেহারা কোনো পরিস্থিতিতেই কাম্য নয় আর এদেশে মৌলবাদের পাশাপাশি সীমাহীন 'ভোগ'এর মানসিকতা সাধারণ জনজীবনে এতই বিস্তৃত যে এই জাতীয় পোষ্টই সিংহভাগ পরিসর দখল করে আছেএর নেপথ্যে সম্প্রচারের 'কারণ' হিসেবে এই পরিসরগুলি 'দ্বন্দ্ব' সৃষ্টির বদলে মালিকের নির্দেশিত পথে সকল গ্রাহককে পরিসেবা দিয়ে চলেছেস্বাভাবিক 'দ্বন্দ্ব' সৃষ্টির ন্যূনতম সম্ভাবনাকেও এইভাবে ভোগের নিরিখে দেখতে বাধ্য করছে সাধারণ মানুষকেতাই আমাদের সামাজিকতার প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে আমরা নিজেরাও গণমাধ্যমের খবর তথা কোনো অনুষ্ঠানের পুনঃপ্রচার, বা ভাইরাল ভিডিও তথা পোষ্টের প্রচার ঘটিয়ে চলেছি আবার নতুন করে পোষ্ট করে। আসলে আমি আপনি এক পরিসর-রাজনীতির চক্রে ক্রমাগত আবর্তিত হচ্ছি, সামান্য একটা নতুন পরিসরের গ্রাহক হয়ে।

তবে এই নতুন ধারার 'পরিসর' পণ্য এবং 'ভোগ' পণ্য তাহলে যে কেউ গ্রাহক বা সাবস্ক্রাইবার হয়ে ব্যবহার করতে পারে এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্নই আর কারুর নেই। এখন গণমাধ্যম নামক একটি প্রযুক্তি-নির্ভর পরিসর সম্পূর্ণভাবে বিকল্প প্রয়োজনে ব্যবহারের প্রসঙ্গটি আমরা আগেই আলোচনা করেছি, এমনকি তাকে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে কতটা সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে পথ চলতে হয় বা আক্ষরিক অর্থে সংগ্রাম করতে হয় তা আমরা জানি বা দেখেছি। এই সংগ্রামের বিপরীতে ভারচুয়াল পরিসরে বৃহৎ-মাঝারি-ছোটো কর্পোরেটের ভারচুয়াল সংস্করণ, নিত্যনতুন প্রয়োজনে ভারচুয়াল গ্রুপিং, ভারচুয়াল বন্ধুত্ব, ভারচুয়াল সম্পর্ক, সমস্ত কিছুর ভারচুয়াল সংস্করণ নিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছি এই সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই মাধ্যমটি কার? নিঃসন্দেহে যে মালিক, তার। আমি কতটা ব্যবহার করতে পারবো? যতটা সেই মালিক আর ভারত রাষ্ট্র অনুমতি দেবে ততটা। কিন্তু সেই অনুমতি সীমার মধ্যে কতটা ব্যবহার করতে পারবো? তাহলে সীমাহীন পরিসর আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। কাজেই শুধু রাজনৈতিকভাবে নিজেকে পরিমার্জনা করে যতটা ব্যবহার করা যায় কর। অন্যের জমিতে চাষ করলে যা হয় আর কি! যতটা বা যতক্ষণ সে অনুমতি দেবে ততটা বা ততক্ষণই তা ব্যবহার করা যাবে। অবশ্য অন্যদিকে থেকে দেখলে এটা তো আবার গণতন্ত্রেরও শর্ত। ছিলাম জমির মালিক আর এখন হয়েছি ভাগচাষী

এই পরিস্থিতিতে একদিকে সোশ্যাল মিডিয়া কর্তৃপক্ষ, এবং অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে সত্তাবৈশিষ্টের মানুষ ও গোষ্ঠীসমূহ যতটা সম্ভব সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে চলেছে। অবশ্য পালটা রাজনৈতিক ব্যবহারও চলেছে পুরোদমে। সামাজিক পরিসরে মৌলবাদী, প্রতিবাদী এবং ভোগবাদী ব্যবহার যতটা বাড়তে পারে নি, বিশাল ভারচুয়াল পণ্য পরিসরে তার বিস্তার চতুর্গুণ বৃদ্ধি পেল। স্বভাবতই মৌলবাদী এবং ভোগবাদী ব্যবহার যতটা বৃদ্ধি পেল, প্রতিবাদী ব্যবহার তেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভোগবাদী মানসিকতা এই পণ্যকে যতটা ব্যবহার করতে পারবে বা বাণিজ্যিক কারণে সোশ্যাল মিডিয়া 'পরিসর' এবং 'ভোগ' নামক পণ্যকে যত বিস্তার ঘটাতে পারছে কোনো প্রতিবাদী মতের বিস্তার ততটা ঘটবে না একথা বলাই বাহুল্য। একদিকে গণমাধ্যম উৎপাদিত সংবাদ পণ্য এবং সংস্কৃতি পণ্য আর অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়ার পরিসর পণ্য এবং ভোগ পণ্য - এই সার্বিক পণ্যায়নই আজকের ভারচুয়াল সামাজিকতার প্রকাশদেশীয় গণমাধ্যমের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ভারতবর্ষীয় রাজনৈতিক-অর্থনীতি আজকের পরিসরের বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে সার্বিক পণ্যায়নের এমন চেহারা আগে দেখেনি। তাই হয়তো মনে হতে পারে চিরায়ত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ধারণায় এ এক স্বাভাবিক উৎপাদিত-পণ্যায়ন প্রক্রিয়াবাস্তবে তা কিন্তু নয়গণমাধ্যমের পণ্য উৎপাদনী প্রক্রিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিসর এবং ভোগ প্রক্রিয়াকেই পণ্য বানিয়ে তোলার ক্ষমতা ধনবাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মূল্যায়নে বিচার করা যাবে না কারণ জনজীবনে এই পণ্যের প্রভাব থাকলেও সামাজিক কোনো ভিত্তি নেই। এ পণ্য সামাজিকতার উপর বিনা বিবর্তনেই প্রযুক্ত হয়, বা সাধারণ কথায় বললে একেবারে চেপে বসে। কারণ কর্পোরেট বাণিজ্যিক শর্তে এই পণ্য বিবর্তিত হয় এবং নতুনতর হয়যেমন 'এডিশন', 'ভারশন', 'জেনারেশন' এই জাতীয় শব্দ-প্রতীকের দ্বারা এই পণ্য নতুনতর হয়ে আত্মপ্রকাশ করেতাই সমকালীন সামাজিকতা গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার এই পণ্যের উদ্ভাবনী ক্ষমতা সম্পর্কে আদৌ অবহিত নয়গণমাধ্যমে তবু এক ধরণের প্রাতিষ্ঠানিকতার সৃজনের প্রকাশ ঘটে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় একেবারে ব্যক্তিগতস্তরে সাংগঠনিক প্রকাশ ঘটে। কারণ কোনো সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি প্রকাশ্যে কোনো সংগঠনকে সাংগঠনিক নিরিখে গ্রাহক হতে দেবে না। একটি 'অ্যাডমিন' দরকার হয়, অর্থাৎ কোনো এক বা একাধিক মানুষকে অ্যাডমিন-এর দায়িত্ব নিতে হয়আর যে নিজেই নিজের ব্যক্তিগত অ্যাডমিন তার ভাবনা সৃজন এবং ইতিমধ্যেই আপলোড করা ফটোশপ করা জনগণ-এর 'ফেক' বা 'জালি' ভিডিও, স্থিরচিত্রে বিকৃত বক্তব্যের দুর্বৃত্তায়ন এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে কোনটা আসল তা বোঝা যায় না। আর কোনটা যে খাঁটি তা কখনোই টের পাওয়া যায় না। ফলত এই পণ্যায়ন চিরায়ত রাজনৈতিক-সামাজিক ভাবনা দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না।

গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল

ভাইরাল হলো গণমাধ্যম তথা সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো পোষ্ট-এর অন্তিম অবস্থা। এই অন্তিম অবস্থায় মনে করা হয় কোনো পোষ্ট জনগণের মোবাইলে মোবাইলে ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো লেখা, ছবি, আলোকচিত্র, এবং ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকের কাছে পৌঁছে গেলে তাকে ভাইরাল বলা যেতে পারে। কখনো গণমাধ্যমে একথা সম্প্রচারিত হয়, এছাড়া যখন কোনো তেমন পোষ্ট বার বার আমার কন্টাক্টের কাছ থেকে আসতে থাকে তখন বোঝা যায় সেটি ভাইরাল হয়েছে। তারপর কী হয়? খুব সোজা - লোকে সেটাকে ভাইরাল মনে করে আবার ব্যবহার করে আর দায়িত্ব শেষ করে সম্ভবত ভুলে যায়। কারণ প্রতিদিন মানুষের জৈবনিক প্রয়োজনে যত পোষ্ট ভাইরাল হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি বিষয় সোশ্যাল মিডিয়া নিজেই পণ্য হিসেবে ভাইরাল করার উদ্যোগ নেয়। অর্থাৎ প্রতিদিন অজস্র বিষয় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্যেই ভাইরাল হয় এবং এইভাবে এক ভাইরাল আর এক ভাইরাল-কে নিষ্ক্রিয় করে তবেই প্রতিষ্ঠিত হয়। তবু এর পরেও গণমাধ্যম অনেক ক্ষেত্রে আবার মনে করায় যে সেই ভাইরাল পোষ্টটির জন্য সামাজিক পরিসরে দারুণ সব কান্ড ঘটে যেতে পারে অথবা ইতিমধ্যেই গেছে। সে আরব-বসন্তই হোক আর কোনো জঙ্গলে ঘটে যাওয়া সাঙ্ঘাতিক কোনো কান্ড - সেই ঘটনাই হোক বা ফটোশপ বা এডিট করা সুনামিতে জনগণের মৃত্যুদৃশ্যের সিনেমাসুলভ ছবিই হোক মোবাইল থেকে মোবাইলে, অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া পরিসরে অবিশ্রান্ত শেয়ার হয়ে চলেছে ভাইরাল হবে বলে।

এখন প্রশ্ন হলো যে কোনো বিষয়ই কি ভাইরাল হতে পারে? হ্যাঁ, যে কোনো বিষয়ের অতিরঞ্জন এবং বিনোদন মূল্যের নিরিখেই ভাবা হয় যে সেটি কেন ভাইরাল হয়েছে। মজার ভিডিও থেকে জাল-ভিডিও সবই এই ভাইরাল হিসেবে তৃতীয় পর্যায়ের পণ্য হয়ে উঠছে। অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ে 'পরিসর' এবং 'ভোগ' পণ্য, দ্বিতীয় পর্যায়ে সংগৃহীত 'বিষয়' হিসেবে পণ্য, আর তৃতীয় পর্যায়ে সেটি ভাইরাল হিসেবে আরও অতিরিক্ত মূল্য অর্জন - এই তিন পর্যায়ের পণ্যের উৎপাদনের নেপথ্যে কৌশলের হদিশ অতি সক্রিয় গ্রাহকও পায় না। শুধু আবার শেয়ার করে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করে। এক্ষেত্রে ভাইরাল হওয়া বিষয়টির মুখ্য বিনোদনমূলক কারণটি এতই গুরুত্ব পায় যে তাতে বিস্তারিত কী লেখা আছে বা তা সেই বিস্তৃতির পথে ক্রমাগত কম পড়া হতে থাকে এবং একসময় এমন পরিস্থিতিও হয় যখন সেই ভাইরাল পোষ্টটি গ্রাহক আর পড়ে দেখার উৎসাহও পায় না, কিন্তু তৎক্ষণাৎ শেয়ার বা পোষ্ট করে দেয়তবে যদি সেটি দুর্ঘটনা, যৌনতা, খেলার চরম কোনো মুহুর্ত, সোশ্যাল মিডিয়ার জন্যই লেখা কবিতা, এমনকি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও চরম কোনো মুহুর্ত ভাইরাল হতে পারে কিন্তু একথা নিশ্চিত যে এগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় পণ্য হিসেবেই ভাইরাল হবেঅর্থাৎ ভাইরাল নিজেই এমন একটি অবস্থা যা গ্রাহক জনগণ 'বিষয়'টি উৎপাদন করলেও নিজে তাকে ভাইরাল করতে পারে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাইরাল বলে প্রচারিত হয়। আর গ্রাহকের মোবাইলে বা কম্পিউটার-এ পৌঁছয় ভাইরাল বিষয় বলে।

কাজেই গণমাধ্যমে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল বলে যা সম্প্রচারিত বা পোষ্ট করা হয়, পণ্যমূল্য হিসেবে তার চটক-মূল্য বা আবেগ-মূল্য থাকলেও বাকি অন্য কোনো বিশেষ মূল্য কতটা থাকে তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায় কারণ সোশ্যাল মিডিয়া বা আজকের বাজারী গণমাধ্যম এমনভাবে নিজের পরিসরকে বিস্তৃত করেছে এবং সেই বিস্তারে এত ভাইরাল পোষ্ট জায়গা নিয়ে বসে আছে যে সমাজ পরিবর্তনের তেমন কোনো সম্ভাবনাকে একেবারে সমূলে নষ্ট করছে। বিনোদন মূল্য ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকছে না। এই পরিস্থিতিতে পরিসর পণ্য এবং সামগ্রিক ভোগ পণ্যের ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠছে না। ফলে যেটা হচ্ছে তা হলো গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবসা এবং আপনি, আমি সেই ব্যবসা বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধিতে যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছি এবং সঙ্গে সঙ্গে পয়সা ব্যয় করেও সাহায্য করে চলেছি এর প্রত্যুত্তরে গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া একেবারে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ঘোষণা করেছে যে গ্রাহক হিসেবে আমরা দারুণ কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারিগণমাধ্যম বাজারের এই স্বীকৃতি তখনই এল যখন আমরা নিজেদের গ্রাহক হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ার সামগ্রিক 'ভোগ' পণ্যের দুনিয়ায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করলাম। এরপরেও অর্থাৎ যদি গ্রাহকসত্তার উর্ধ্বে আমাদের আর কোনো সত্তা এই পরিসরে থেকে থাকে তাহলে সমাজ পরিবর্তনের লড়াইও হবেতবে যদি সত্যিই তেমন সম্ভাবনা তৈরী হয় তাকে পরিসর ভোগ'এর উর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে কোনো গ্রাহক যদি মৌলবাদী, অপরাধী হয় তাহলে বাকি গ্রাহক বাহিনী মানুষ হয়ে এর বিরোধিতা করবেই তবু চলুক এই বিরোধিতা, কিন্তু এই ভোগ পণ্যের ব্যবহারের মতাদর্শগত বিকল্পের কী হবে? মনে রাখতে হবে পরিসর ভোগী অধিকাংশ মানুষের সমাজ পরিসর অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত। বাকি এই বিশাল জনসংখ্যার কথা ছেড়েই দিলাম বর্তমান সমাজ নামক আসলে বাজার  পরিসরে গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মাধ্যমে সাধারণ মানুষের এর অতিরিক্ত আখ্যান আর কীই বা হতে পারে।

No comments:

Post a Comment